উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় করার অপরিহার্য
অংশ রক্তচাপ মান যন্ত্র। ইংরেজিতে বলা হয় স্ফিগমোম্যানোমিটার (sphygmomanometer)। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই হাসপাতালে, ওষুধের দোকানে রক্তচাপ মাপার এ যন্ত্রটি ত্রুটি পূর্ণ । বিভিন্ন হাসপাতালে একবার
জরীপ করে দেখা গিয়েছিল যে রক্তচাপ মাপার যন্ত্র পঞ্চাশ শতাংশ ক্ষেত্রেই নির্ভুল নয়। অতএব রক্তচাপ মাপার জন্য
প্রথমেই চাই ভালো রক্তচাপমান যন্ত্র।
রক্তচাপ মাপার দুটি উপায় রয়েছেঃ
১। প্রত্যক্ষ পদ্ধতিঃ এ পদ্ধতিতে ধমনীর ভেতরে একটি ক্যানুলা
ঢোকানো হয় এবং পারদ ম্যানোমিটারের সাহায্যে সরাসরি রক্তচাপ মাপা হয়। অনেক সময় অসিলোগ্রাফির
সাহায্যে তা কাগজে রেকর্ডও করা হয়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় না।
২। পরোক্ষ পদ্ধতিঃ আমরা সচরাচর যেভাবে রক্তচাপ মাপি সেটা পরোক্ষ পদ্ধতি। এজন্য আগে পারদ রক্তচাপমান যন্ত্র বা Mercury
sphygmomanometer বেশী ব্যবহার করা হতো। আজকাল অ্যানোরয়েড
রক্তচাপ মাপার যন্ত্রই বেশী প্রচলিত। অনেকে ডিজিটাল যন্ত্রও ব্যবহার করেন।তবে ডিজিটাল যন্ত্রের দাম
বেশী এবং ঠিকমতো ব্যবহার না করলে রিডিং-এ গড়মিল হতে পারে। রক্তচাপ মাপার জন্য রক্তচাপমান
যন্ত্র ছাড়া একটি স্টেথোস্কোপ দরকার হয়।অবশ্য হাত দিয়ে ধমনী পরীক্ষা করে স্টেথোস্কোপ ছাড়াও রক্তচাপ মাপা যায়। কিন্তু তাতে শুধু সিস্টোলিক
রক্তচাপ মাপা যায়।
একজন মানুষের রক্তচাপ প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তিত হয়। শ্বাস, মানসিক উত্তেজনা,
ব্যায়াম, সিগারেট, অ্যালকোহল,উষ্ণতা, খাবার-দাবার-এসব নানা কারণে রক্তচাপ ওঠানামা করে। এজন্য কারও রক্তচাপ মাপার
আগে তাকে স্বাভাবিক ও শিথিল অবস্থায় একটি আরামদায়ক উষ্ণ কক্ষে বসানো উচিত। সব ধরণের শারীরিক ও মানসিক চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে
এবং রক্তচাপ মাপার কমপক্ষে আধ ঘণ্টা আগে খাওয়া এবং ধূমপান বর্জন করতে হবে। রক্তচাপ মাপার সময় রোগীর
বাহুতে চাপ সৃষ্টিকারী কোন কাপড় থাকা উচিত না। রক্ত চাপমান যন্ত্রের ঘড়ি হৃদপিণ্ডের একই তলে অবস্থান করতে হবে। পরীক্ষার সময় রোগীর দুই বাহুতেই রক্তচাপ মাপা উচিত।
রক্তচাপ মাপার জন্য চাপবিহীন অবস্থায় রক্তচাপ মাপার যন্ত্রের কাফ-এর নীচের প্রান্ত কনুইয়ের সামনের ভাঁজের ২.৫ সেঃ মিঃ
ওপরে ভালোভাবে আটকাতে হয়। কনুইয়ের সামনে হাত দিয়ে ব্রাকিয়াল ধমনীর অবস্থান স্থির করে
তার ওপর স্টেথো স্কোপের ডায়াফ্রাম বসানো হয়। ডায়াফ্রাম এমনভাবে চাপ দেওয়া উচিত যেন ডায়াফ্রাম এবং ত্বকের
মাঝখানে কোন ফাঁক না থাকে। কারণ এরফলে ডায়াস্টোলিক চাপ পরিমাপে কম হতে পারে। চাপ মাপার সময় স্টেথো স্কোপ
কাপড় কিংবা কাফের ওপরে রাখা যাবে না। এরপর রেডিয়াল ধমনী অনুভব করা হয় এবং ধীরে ধীরে চাপমান যন্ত্রের
চাপ বাড়ানো হয়। রেডিয়াল পালস
বন্ধ হওয়ার পর চাপ ৩০ মিঃ মিঃ ওপরে নেওয়া হয়। তারপর আস্তে আস্তে চাপ কমানো
হয়। প্রতি বিটে সাধারণত ২ মিঃ
মিঃ চাপ কমানো হয়। তাড়াতাড়ি চাপ
কমালে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। | যে চাপে ধমনী পাওয়া যায়
তা খেয়াল করে আবার চাপ বাড়ানো হয়। এবার চাপ কমানোর সময় স্টেথো স্কোপ দিয়ে ব্রাকিয়াল ধমনীতে
সৃষ্ট শব্দ মনোযোগের সঙ্গে শোনা হয়। চাপ কমতে শুরু করলে রক্ত চলাচলের ফলে এক ধরণের শব্দ সৃষ্টি
হয়। একে করটকফ শব্দ ( Korotkoff
sound) বলা হয়। করটকফ শব্দ ধাপে ধাপে পরিবর্তন
হয়। এই শব্দের ধরন অনুসারে পাঁচটি
পর্যায় রয়েছেঃ
পর্যায়-১ প্রথমে এক ধরণের তীক্ষ্ণ শব্দের সৃষ্টি হয়। এটা সিস্টোলিক রক্তচাপ নির্দেশ করে।
পর্যায়-২ উঁচু ঝির ঝির (Swishing) শব্দ।
পর্যায়-৩ নিচু পরিষ্কার শব্দের সঙ্গে সামান্য ঝির ঝির শব্দ।
পর্যায়-৪ এ পর্যায়ে শব্দের তীক্ষ্ণতা কমে আসে (Muffling)।
পর্যায় -৫ এ সময়ে করটকফ শব্দ থেমে যায়।
উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় প্রথম একবার শব্দ হওয়ার
পর আর শব্দ তৈরি হয় না। পারদচাপ বেশ কিছু কমার পর আবার শব্দ শোনা যায়। এই ফাঁকা অংশকে অস্কাল্টেটরি
গ্যাপ বলে (Auscultatory gap)। এইজন্য অনেক সময় সিস্টো লিক রক্তচাপ কম মনে হতে পারে। এটা এড়া নোর জন্য রেডিয়াল
ধমনী অনুভব করা অপরিহার্য । করটকফ শব্দ বন্ধ হয়ে যাওয়ার
সঙ্গে সঙ্গেই আবার রক্তচাপ মাপা উচিত নয়। এজন্য কিছু সময় বিরতি দেওয়া
ভালো।
করটকফ শব্দের প্রথম পর্যায়ে যে শব্দ শোনা যায় সেটাই সিস্টোলিক রক্তচাপ। সিস্টো লিক রক্তচাপ সম্পর্কে
একমত হলেও ডায়াস্টোলিক রক্তচাপের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন চতুর্থ ধাপে যেখানে
শব্দের তীক্ষ্ণতা কমে যায় (Muffling) সেটাই ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ। আবার অনেকের মতে পর্যায়-৫ অর্থাৎ যে চাপে শব্দ বন্ধ হয়ে যায়
সেটাই ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ। তবে আজকাল অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ শেষের পরিমাপটিকে ডায়াস্টোলিক
রক্তচাপ হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।
দুই মিনিট ব্যবধানে কিংবা তিনবার রক্তচাপ মেপে তার গড় মাপ হিসেব করা উচিৎ। দুইবার রক্তচাপ মাপলে দুটো
রিডিং-এর ব্যবধান যদি ৫ মিঃ মিঃ পারদ চাপের বেশী হয় তাহলে আবার রক্তচাপ মেপে দেখা উচিৎ।
রক্তচাপ মেপে রিডিং রোগীকে জানিয়ে দেওয়া উচিৎ। অবশ্য লক্ষ্য রাখতে হবে
কেউ যেন উচ্চ রক্তচাপের কথা শুনে অকারণে ভীত, শঙ্কিত কিংবা উত্তেজিত না হয়। রক্তচাপ কত থাকলে কি পদক্ষেপ
নিতে হবে এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে।
রক্তচাপের পর্যায়
|
সিস্টোলিক রক্তচাপ
( মিঃ মিঃ পারদচাপ)
|
ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ
( মিঃ মিঃ পারদচাপ)
|
জীবনাচরণ পরিবর্তন
|
রক্তচাপের ওষুধ
|
|
জরুরী নির্দেশনা নেই
|
জরুরী নির্দেশনা আছে
|
||||
স্বাভাবিক
|
< ১২০
|
এবং < ৮০
|
উৎসাহিত করা উচিৎ
|
ওষুধ সেবনের প্রয়োজন নেই
|
ওষুধ সেবন করতে হতে পারে
|
প্রাক-উচ্চ রক্তচাপ
|
১২০-১৩৯
|
অথবা ৮০-৮৯
|
জীবনাচরণ পদ্ধতি পালন করতে হবে
|
||
পর্যায়-১
|
১৪০-১৫৯
|
অথবা ৯০-৯৯
|
জীবনাচরণ পদ্ধতি পালন করতে হবে
|
ওষুধ সেবন করতে হবে
|
ওষুধ সেবন করতে হবে
|
পর্যায়-২
|
>১৬০
|
>১০০
|
জীবনাচরণ পদ্ধতি পালন করতে হবে
|
ওষুধ সেবন করতে হবে
|
ওষুধ সেবন করতে হবে
|
- সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টোলিক রক্তচাপের পর্যায় ভিন্ন হলে সর্বোচ্চ পর্যায়কেই গণনায় নিতে হবে। ( যেমন কারও রক্তচাপ ১৭০ / ৯৫ মিঃ মিঃ পারদ চাপ হলে তাকে পর্যায় -২ হিসেবে গণনা করতে হবে এবং সেই মোতাবেক চিকিৎসা দিতে হবে।)
- রক্তচাপ যাই হোক না কেন, হৃদপিন্ডের অবস্থা কিংবা অন্যান্য টার্গেট অর্গানের পরিস্থিতি বুঝে নির্ধারিত সময়ের আগেও চিকিৎসা শুরু করতে হতে পারে কিংবা হাসপাতালে পাঠাতে হতে পারে।
No comments:
Post a Comment