।।দশ।। উচ্চ রক্তচাপ ও মস্তিস্ক



 
মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ-কর্ম, বিশেষ করে হৃদপিণ্ড এবং রক্তনালীর কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিস্ক থেকে এর গঠন এবং কাজের ধারা জটিল কতটা জটিল তার উদাহরণ দিতে গিয়ে বলা হয়, মস্তিস্কের কাজটুকু করতে পারে, এমন একটি টেলিফোন এক্সচেঞ্জ বানাতে গেলে যে যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হবে তাতে নিউইয়র্ক শহরের একশো তলা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এর মতো ছয়টা বাড়ী ভরে যাবে টেলিফোনের ক্যাবলের ওজন  দাঁড়াবে কয়েক শত টন আর এই বিশাল যন্ত্রপাতিকে ঠান্ডা রাখতে আমেরিকার হাডসন নদীর সবটুকু পানি লেগে যাবে  মস্তিস্কের এমন জটিল কার্যকলাপ সুষ্ঠু ভাবে অব্যাহত রাখার জন্য অক্সিজেন, গ্লুকোজ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদানের সরবরাহ নিশ্চিত রাখা দরকারী এজন্য মস্তিস্কের রক্তপ্রবাহ বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত স্বল্পমেয়াদী উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে মস্তিস্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সংবেদী এবং উপ-সংবেদী স্নায়ুতন্ত্র ও রাসায়নিক পথসমূহ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে দীর্ঘমেয়াদী রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ভূমিকা কতটুকু তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে  
       রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টির পেছনে মস্তিস্কের ভূমিকা রয়েছে সত্য; কিন্তু মস্তিস্কের ওপরও উচ্চ রক্তচাপের অনেক প্রভাব রয়েছে উচ্চ রক্তচাপজনিত জটিলতা সমূহের মধ্যে স্ট্রোক বা পক্ষাঘাত অন্যতম উচ্চ রক্তচাপের ফলে মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ কিংবা রক্ত সরবরাহ বন্ধ হওয়ার কারণে স্ট্রোক বা পক্ষাঘাত হয় এছাড়া অতিরিক্ত রক্তচাপের জন্য হাইপারটেনসিভ এনসেফালোপ্যাথিও হতে পারে  
       উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করলে স্ট্রোকের হার কমানো যায় উন্নত দেশে স্ট্রোক মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ হৃদরোগ এবং ক্যানসারজনিত মৃত্যুর পরেই এর স্থান  
এখানে স্ট্রোক সম্পর্কে কিছু কথা বলা প্রয়োজন
          স্ট্রোকের আরেক নাম সেরিব্রোভাস্কুলার ডিজিস (Cerebrovascular disease) কোন কারণে মস্তিস্কের রক্তনালীর সমস্যার কারণে স্নায়ুতন্ত্রের কোন অংশের কার্যকলাপ ব্যাহত  হলে তাকে স্ট্রোক বলা হয় অবশ্য শর্ত হচ্ছে স্নায়ুতন্ত্রের কাজকর্ম ২৪ ঘণ্টার বেশী ব্যাহত হতে হবে স্থায়িত্ব এর কম হলে সেটাকে সাময়িক রক্ত সরবরাহ ঘাটতিজনিত গোলযোগ (Transient ischaemic attack-TIA) বলা হয় মস্তিস্কের রক্তনালীর সমস্যা নান রকম হতে পারে এটা ছিঁড়ে কিংবা ফেটে যেতে পারে, রক্তপিণ্ড দিয়ে বন্ধ হয়ে যেতে পারে( thrombosis) অথবা আথেরস্ক্লেরোসিসের ফলে এর ভেতরের ফুটো সরু হয়ে যেতে পারে যে কারণেই সমস্যা হোক, মস্তিস্কের কোন অংশে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে ওই অংশ বিনষ্ট হয়ে যায় বা মরে যায় এবং কার্যকারিতা হারায় ফলে মস্তিস্কের ওই অংশ দ্বারা শরীরের যে অংশের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত হতো তা ব্যাহত হয়; শরীরের অংশবিশেষ অচল এবং অবশ হয়ে যায় যা প্যারালাইসিস নামে পরিচিত
সারনি-১০ স্ট্রোকের ঝুঁকি উপাদান

প্রধান ঝুঁকি উপাদান
 অন্যান্য

উচ্চ রক্তচাপ
অতিরিক্ত মদ্যপান

ধূমপান
পরিবারের অন্যদের স্ট্রোকের ইতিহাস

ডায়াবেটিস
জন্ম নিরোধক বড়ি

রক্তে অস্বাভাবিক   কোলেস্টেরল


পলিসাইথেমিয়া





থ্রম্বোসাইথেমিয়া





স্ট্রোকের প্রধান কারণই হোল উচ্চ রক্তচাপ উচ্চ রক্তচাপের কারণে মস্তিস্কের রক্ত নালী ফেটে কিংবা ছিঁড়ে যায় এবং মস্তিস্কের ভেতর রক্তক্ষরণ হয় (cerebral haemorrhage) অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে মস্তিস্কের রক্তনালীতে আথেরস্ক্লেরোসিস থাকতে পারে সেক্ষেত্রে রক্ত নালী বন্ধ হয়ে মস্তিস্কের ওই অংশে রক্ত সরবরাহ কমে যায় এবং মস্তিস্কের অংশ বিশেষের কোষ কলা মরে যায় (cerebral infarction)  

স্ট্রোকের ফলে সাধারণত শরীরের এক দিকের হাত-পা অবশ হয়ে যায় এটা সহসাই ঘটে এবং রোগী অনেক সময় অজ্ঞান হয়ে যায় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে, ওষুধ অনিয়মিত খেলে, অধিক উত্তেজিত হলে কিংবা টেনশনের ফলে এ ধরণের ঘটনা বেশী হয় এর ফলে অনেক রোগী সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় যারা বেঁচে থাকে তাদের অধিকাংশ উপযুক্ত চিকিৎসা পেলে মোটামুটি কর্মক্ষম হয়ে ওঠে কিন্তু অনেক রোগী কোন ভাবেই আর পূর্বের মতো কর্মক্ষম হয়ে উঠতে পারে না শরীর ও  মনের অচল অবশ অবস্থা নিয়ে পরিবারের জন্য এক দুর্বিষহ বোঝা হয়ে বেঁচে থাকতে হয়
       শিল্পোন্নত দেশগুলিতে স্ট্রোকের জন্য শতকরা ১০ থেকে ১২ ভাগ লোক মারা যায় জাপানে এ হার সবচেয়ে বেশী সেখানে ২৫% মানুষের মৃত্যুর কারণ এই স্ট্রোক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে এ হার ১০% আমাদের দেশে স্ট্রোকের হার ও মৃত্যু সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য গবেষণা হয়েছে কম তবে প্রতিটি বড় হাসপাতালে স্ট্রোকের রোগী ভর্তির আধিক্য দেখে এর ব্যাপকতা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী ভর্তির দ্বিতীয় প্রধান কারণ স্ট্রোক ১৯৮৩ সালে এই হাসপাতালে মেডিসিন ইউনিট-১-এ ভর্তি হওয়া ৬৭৯৪ জন রোগীর মধ্যে ৬৯৩ জনই (১০.২%) ছিল স্ট্রোকের রোগী চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঁচ বছরের এক হিসেবে দেখা যায় ২.৯% রোগীর স্ট্রোক হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওই সময়ে যত উচ্চ রক্তচাপের রোগী ভর্তি হয়েছে তাদের মধ্যে শতকরা ২৯ জনের স্ট্রোক ছিল  
       স্ট্রোকের ঝুঁকি দূর করতে পারলে এর সংখ্যা অনেকখানি কমানো সম্ভব যেহেতু ঝুঁকিসমূহের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপই প্রধান, এ জন্য এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী আন্তর্জাতিক নয়টি খুব বড় ধরণের পর্যবেক্ষণে মোট ৪,২০,০০০ লোকের ওপর ১০ বছর সমীক্ষা করে দেখা গেছে ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ ৫, ৭.৫ এবং ১০ মিঃ মিঃ পারদ চাপ কম রাখতে পারলে স্ট্রোকের হার যথাক্রমে ৩৪%,৪৬% এবং ৫৬% কমে যায়  

সারনী-১১  দশ বছর যাবত ৪,২০,০০০ লোকের ওপর পরিচালিত ৯টি পর্যবেক্ষণের ফলাফল 
ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ কমানো হয়েছে
স্ট্রোকের হার কমেছে
৫ মিঃ মিঃ পারদচাপ
৩৪%
৭.৫ মিঃ মিঃ পারদচাপ
৪৬%
১০ মিঃ মিঃ পারদচাপ
৫৬%

প্রধান পর্যবেক্ষণসমূহের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এমন কি মৃদু উচ্চ রক্তচাপেরও নিয়মিত চিকিৎসা করালে স্ট্রোকের হার এক তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত কমে যায় কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের হার সে অনুপাতে কমে না এর ব্যাখ্যা অবশ্য তেমন পরিস্কার নয় হতে পারে উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের ক্ষেত্রে যেমন একটি প্রধান কারণ, হার্ট অ্যাটাকের বেলায় তেমন একমাত্র কারণ নয় কারণ হার্ট অ্যাটাকের পেছনে আরও অনেক রকম ঝুঁকি কাজ করে
       বিগত তিন দশকের পর্যবেক্ষণগুলিতে প্রমাণিত হয়েছে যে, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করলে স্ট্রোকের হার কমানো যায় এটা আমাদের দেশেও বাস্তবায়ন করা সম্ভব কিন্তু এজন্য উচ্চ রক্তচাপের  চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া জরুরী একবার উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার চিকিৎসা সারা জীবন অব্যাহত রাখতে হয় ১৯৯৪ সালের এক পর্যবেক্ষণে দেখা যায় অনেক স্ট্রোকের রোগী তাদের উচ্চ রক্তচাপের কথা জানতো না, কিংবা জানলেও নিয়মিত ওষুধ সেবন করতো না একবার উচ্চ রক্তচাপের রোগীর পক্ষাঘাত হয়ে যাওয়ার পর তার উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন উপযুক্ত চিকিৎসকের পরামর্শ    অনুসারে চলা ভালো উচ্চ রক্তচাপজনিত স্ট্রোক প্রতিরোধ করতে হলে নিয়মিত ওষুধ সেবন এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব রোগী এবং তার পরিবারের সদস্যদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে

No comments:

Post a Comment