আমরা আগেই বলেছি হৃদপিণ্ড নামের
যে যন্ত্রটি সবসময় রক্ত সঞ্চালন করে আমাদের জীবিত রাখে তা আসলে একটি পেশী বহুল পাম্পবিশেষ
। সুস্থ হৃদপিণ্ড সুস্থ জীবনের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু কারও অনেকদিন
উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তার ধকল সইতে হয় হৃদপিণ্ডকে। এর ফলে নানা রকম
জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। যেমনঃ
·
রক্ত সরবরাহে ঘাটতিজনিত হৃদরোগ(Ischaemic
heart disease)
·
বাম নিলয়ের অতিবৃদ্ধি (Left
ventricular hypertrophy)
·
হৃদপিণ্ডের বিকলতা বা হার্ট ফেইলিউর (heart failure)
রক্ত সরবরাহে ঘাটতিজনিত হৃদরোগ
দেহের যে কোন অংশে প্রয়োজনের তুলনায় রক্ত সরবরাহ কমে গেলে
তাকে ইস্কিমিয়া (ischaemia) বলা হয়। হৃদপিণ্ডের মায়োকার্ডিয়াম বা পেশীতে রক্ত সরবরাহে ঘাটতি হলে তাকে ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ (ischaemic heart disease) বা রক্ত সরবরাহ ঘাটতিজনিত হৃদরোগ
বলা হয়। অনেকে এটাকে করোনারি
আর্টারি ডিজিজ বা করোনারি হৃদরোগও বলে থাকেন। কারণ অধিকাংশ
ক্ষেত্রে করোনারি ধমনী আথেরস্ক্লেরোসিস হয়ে সরু হয়ে যাওয়ার ফলেই রক্ত সরবরাহে সমস্যা
সৃষ্টি হয়। আর রক্ত সরবরাহ কমে যাওয়া মানে হৃদপিণ্ডের পেশীতে
অক্সিজেন ও অন্যান্য পুষ্টি সরবরাহ কমে যাওয়া। করোনারি ধমনীতে
রক্ত সরবরাহ কতটুকু কমে গেছে, কত তাড়াতাড়ি কমে গেছে, বিকল্প ধমনী পথে কি পরিমাণে রক্ত
প্রবাহিত হচ্ছে এ রকম উপাদানের ওপর ইস্কিমিক হৃদরোগের তীব্রতা
ও প্রকাশভঙ্গী নির্ভরশীল। সাধারণ ইস্কিমিক হৃদরোগের প্রকাশ বিভিন্ন রকম হতে পারেঃ
·
অ্যানজাইনা পেকটোরিস (angina
pectoris)
·
মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বা হার্ট অ্যাটাক (Myhocardial infarction)
·
হৃদপিণ্ডের বিকলতা (heart
failure)
·
হঠাৎ মৃত্যু (sudden cardiac death)
শিল্পোন্নত দেশগুলিতে
হৃদরোগে মৃত্যুর প্রধান কারণ ইস্কিমিক হৃদরোগ; উন্নয়নশীল দেশগুলিতেও এর প্রকোপ দিন
দিন অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর যত লোক হৃদরোগে
মারা যায় তাদের ৮০% থেকে ৯০% মারা যায় ইস্কিমিক হৃদরোগের জন্য। তিন দশক আগে প্রতি
লাখে ২১৫ জন এ রোগে মারা যেত। ১৯৮৫ সালে এ মৃত্যু হার ছিল প্রতি লাখে ১২৭ জন। অর্থাৎ মৃত্যুর
হার ৪০% শতাংশ কমেছে। ইস্কিমিক হৃদরোগে মৃত্যুহার কমার কারণ হৃদরোগ প্রতিরোধ
ব্যবস্থা জোরদার করা, উন্নত স্বাস্থ্য সেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং
সর্বোপরি উন্নততর চিকিৎসা পদ্ধতি।
ইস্কিমিক হৃদরোগের কারণ কি? এ পর্যন্ত বিভিন্ন
পর্যবেক্ষণ এবং সমীক্ষার মাধ্যমে এর অনেক কারণ শনাক্ত করা হয়েছে।
১। আথেরস্ক্লেরোসিস(atherosclerosis)
ইস্কিমিক হৃদরোগের প্রধান কারণ করোনারি ধমনীর আথেরস্ক্লেরোসিস। নদী কিংবা খালে পলি জমলে যেমন পানিপ্রবাহ
বিঘ্নিত হয়; তেমন ধমনীর গায়ে আথেরস্ক্লেরোসিস হলে হৃদপেশী প্রয়োজনের সময়ে পর্যাপ্ত
রক্ত পায় না। ফলে ইস্কিমিক বা রক্ত সরবরাহ ঘাটতিজনিত হৃদরোগ হয়।
আমাদের হৃদপিণ্ডের
সব সময় একই পরিমাণ রক্ত দরকার হয় না। আমরা যখন সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠি, জোরে হাঁটি, দৌড়াই
কিংবা ভারী কোন কাজ করি তখন হৃদপিণ্ডের কাজের পরিমাণ বেড়ে যায়। কারণ হৃদপিণ্ডকে
তখন শরীরের বাড়তি চাহিদা অনুসারে অতিরিক্ত অক্সিজেন যোগানোর জন্য অতিরিক্ত রক্ত সরবরাহ করতে হয়। আর হৃদপিণ্ডের
নিজেরও রক্ত বেশী দরকার হয় তখন। কিন্তু আমরা যখন বিশ্রাম নেই কিংবা ঘুমাই তখন আমাদের
শরীরে অক্সিজেন ও শক্তির চাহিদা কমে যায়। ফলে হৃদপিণ্ডের
নিজের জন্যও কম রক্ত সরবরাহ হলে চলে।
মুশকিল হচ্ছে
হৃদপিণ্ডের অক্সিজেন ও পুষ্টির চাহিদা প্রবল এবং এ ক্ষেত্রে আপোষের কোন সুযোগ নেই। হৃৎপেশী প্রয়োজন
মতো রক্ত না পেলে সমস্যা হয়। হৃৎপেশী সেটা বুকের ব্যাথা আকারে আমাদের জানান
দেয়। স্বাভাবিক বিশ্রামের সময় প্রয়োজনের তুলনায় রক্ত
কম গেলে আমরা অসুবিধা অতটা টের পাই না। কিন্তু অতিরিক্ত পরিশ্রম কিংবা ভারী কাজ কর্মের
সময় সাংঘাতিক সমস্যা সৃষ্টি হয় এবং বুকের মাঝখানে ব্যাথা হয়। এটাই অ্যানজাইনা
বা বক্ষশূল। এটা ইস্কিমিক হৃদরোগের একটি সাধারণ প্রকাশ। অ্যানজাইনার ব্যাথা
বুকের মাঝখানে হয়। ভারী কাজ করলে, জোরে হাঁটলে, দৌড়ালে, সিঁড়ি দিয়ে
ওপরে উঠলে কিংবা পাহাড়ে উঠলে এই ব্যথা শুরু হয়; সাধারণত এই ব্যাথা কয়েক মিনিট স্থায়ী
হয়; কখনই ৩০ মিনিটের বেশী সময় থাকে না। বুকের মাঝখান থেকে ব্যাথা বাম ঘাড়ে, বাহু এবং হাত
পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে। কারও কারও চোয়ালে, দাঁতে কিংবা পেটের ওপরেও ব্যাথা
ছড়িয়ে যেতে দেখা যায়। এজন্য অনেক সময় রোগীরা অ্যানজাইনাকে ঘাড়ের ব্যাথা,
দাঁতের ব্যাথা কিংবা পেটে গ্যাস হয়েছে বলে মনে করে থাকে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম
নিলে কিংবা জিভের নীচে জিটিএন ট্যাবলেট দিলে এই ব্যাথা কমে যায়।
হৃদপিণ্ডের পেশীতে
রক্ত সরবরাহ করার প্রধান পথ আসলে দুটি - ডান এবং বাম করোনারি ধমনী। মহাধমনীর গোড়া থেকে এ দুটি যাওয়ার পর ছোট ছোট শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে
যায় এবং পেশীর গভীর স্তরে ঢুকে পেশীকে রক্ত সরবরাহ করে।
চিত্রঃ করোনারি
ধমনীর রোগ
|
আথেরোস্ক্লেরোটিক প্লাক দিয়ে এই ধমনী আংশিক বন্ধ হয়ে গিয়েছে।আংশিক
বন্ধ হলে অ্যানজাইনা ; আর পুরোপুরি বন্ধ হলে হার্ট অ্যাটাক হয়।
করোনারি ধমনী
দুটি এবং এদের শাখা-প্রশাখাসমূহ আসলে সরু নল বিশেষ। পানি
প্রবাহের জন্য পাইপের ভেতরটা যেমন ফাঁকা থাকা চাই ; রক্ত সরবরাহ সুষ্ঠু ভাবে
অব্যাহত রাখার জন্য করোনারি ধমনীর ভেতরটাও তেমন ফাঁকা থাকা দরকার। কোন কারণে
রক্তনালীর ভেতরটা বুজে গেলে রক্তের প্রবাহ কমে যায়। ফলে
হৃদপিণ্ড কাজের জন্য যথেষ্ট রক্ত পায় না এবং বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন
পর্যবেক্ষণে দেখা গিয়েছে করোনারি ধমনীর ভেতরে শতকরা ৭০ ভাগ কিংবা তারচেয়ে বেশী অংশ
বুজে গেলে রক্ত সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে এবং বিভিন্ন উপসর্গের সৃষ্টি হয়। আথেরোস্ক্লেরোসিসের
কারণে মূলত করোনারি ধমনীর ভেতরটা বুজে যায়।
আথেরোস্ক্লেরোসিস এমন একটি প্রক্রিয়া যার ফলে ধমনীর ভেতরে চর্বি জাতীয় পদার্থ
স্তরে স্তরে জমে যায়। শরীরের সব বড় এবং মাঝারী গোছের ধমনী এতে
আক্রান্ত হতে পারে এবং এর ফলে ওই সমস্ত অঙ্গেও রক্ত সরবরাহ কমে যায়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় অনেক পক্ষাঘাতের মূলে রয়েছে মস্তিস্কে রক্ত সরবরাহকারী ধমনীর
আথেরোস্ক্লেরোসিস।
ধমনীর গায়ে
আথেরোস্ক্লেরোসিস কেন হয় তার সঠিক ব্যাখ্যা জানা নেই। তবে বিভিন্ন
পর্যবেক্ষণের সাহায্যে এর পেছনে থাকা অনেক কারণ শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলিকে বলা
হয় ঝুঁকি উপাদান (Risk factors)। এগুলি দুই ধরনেরঃ
ক) অপরিবর্তনীয় ঝুঁকি (non-modifiable
risk factors)
এ সব ঝুঁকি উপাদান
এমন যে এদের ওপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। আমরা ইচ্ছে করলেও
এগুলি নিয়ন্ত্রণ কিংবা পরিবর্তন করতে পারি না। যেমনঃ
১) হৃদরোগের পারিবারিক ইতিহাস
কারও পরিবারে
যদি অল্প বয়সে আথেরোস্ক্লেরোসিস এবং হৃদরোগের
ইতিহাস থাকে, তাহলে তার অন্য স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় আথেরোস্ক্লেরোসিস এবং হার্ট
অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে।
২) বয়স
মানুষের বয়স যত
বাড়ে ততই তার শরীরের সকল ধমনী পুরু ও শক্ত
হতে থাকে। শরীরের অন্যান্য অংশের ধমনী যখন এমন পুরু আর শক্ত
হয় তখন বিপদের কারণ ঘটে। সাধারণত ৩৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সের মধ্যে আথেরোস্ক্লেরোসিস
হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। প্রতি পাঁচটি হার্ট অ্যাটাকের চারটি ঘটে যাদের
বয়স ৬৫ বছরের ওপরে।
৩) লিঙ্গ
বিধাতা এ ক্ষেত্রে
পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের প্রতি কৃপাদৃষ্টি প্রদর্শন করেছেন। সন্তান ধারণক্ষম
মেয়েদের আথেরোস্ক্লেরোসিস হওয়ার সম্ভাবনা পুরুষদের চেয়ে অনেক কম। অবশ্য রজঃনিবৃত্তির
পর মেয়েরা আর নিরাপদ থাকে না। তখন তারাও পুরুষদের মতো এ সমস্যায় আক্রান্ত হতে
পারে। এছাড়া একুশ শতকের দ্বারপ্রান্তে এসে মেয়েরাও পিছিয়ে
নেই। কারণ আধুনিক
জীবনযাত্রা, ধূমপান এবং ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপ ও উত্তেজনার ফলে তারাও অধিক
হারে হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
সারণীঃ ৭ করোনারি হৃদরোগের
দশটি ঝুঁকি
|
|
অপরিবর্তনীয় ঝুঁকি
|
নিয়ন্ত্রণযোগ্য ঝুঁকি
|
·
হৃদরোগের পারিবারিক
ইতিহাস
·
বয়স
·
লিঙ্গ
|
·
উচ্চ রক্তচাপ
·
ধূমপান
·
রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল
·
ডায়াবেটিস মেলিটাস
·
ব্যায়াম না করা
·
মেদ ভুঁড়ি
·
টাইপ-এ ব্যক্তিত্ব
|
খ) নিয়ন্ত্রণযোগ্য
ঝুঁকি (modifiable risk factors)
এ সকল ঝুঁকি আমরা ইচ্ছে করলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি কিংবা পালটাতে পারি। যেমনঃ
১) উচ্চ রক্তচাপ
এটা আথেরোস্ক্লেরোসিস
এবং হৃদরোগের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি। দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচাপ থাকলে ধমনীর ভেতরের আস্তরণে
ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং সেখানে আথেরোস্ক্লেরোসিসের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
২)
রক্তে অস্বাভাবিক কোলেস্টেরল
রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশী হয়ে গেলে করোনারি ধমনীতে আথেরোস্ক্লেরোসিসের
ঝুঁকি বেড়ে যায়। কোলেস্টেরল, কোলেস্টেরল এস্টার , ফসফোলিপিড, ট্রাই-
গ্লিসারাইড প্রভৃতি চর্বিজাতীয় পদার্থ রক্তে গলে না। এ গুলিকে বহন করে এক শ্রেণীর প্রোটিন বাহক। এদের বলা হয় লাইপোপ্রোটিন
(lipo-protein)। লাইপোপ্রোটিন বিভিন্ন রকম হতে পারে।কম ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিনে (low density lipoprotein) অধিক মাত্রায় কোলেস্টেরল থাকে। এই লাইপোপ্রোটিন লিভার থেকে কোলেস্টেরল বয়ে এনে
ধমনীতে জমা করে। আর বেশী ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন (high density lipoprotein) ধমনী থেকে কোলেস্টেরল বের করে লিভারে নিয়ে যায়। অর্থাৎ এল ডি এল বেশী থাকলে এবং এইচ ডি
এল কম থাকলে হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ সম্পর্কে পরবর্তীতে আরও বিস্তারিত আলোচনা
করা হয়েছে।
৩) ধূমপান
প্রতি বছর মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে হৃদরোগে পাঁচ লাখেরও বেশী মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে ধূমপানের
কারণে এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ১,৭০,০০০ মানুষ মারা যায়। প্রতিদিন এক প্যাকেট
সিগারেট হৃদরোগের ঝুঁকি দ্বিগুণ করে দেয়। ধূমপানের ফলে
ধমনীর গায়ে ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং আথেরোস্ক্লেরোসিস বেশী হয়। অধূমপায়ীদের চেয়ে
ধূমপায়ীদের হৃদক্রিয়া বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি তিনগুণ বেশী। ধূমপায়ীরা এটা
ছেড়ে দেওয়ার এক থেকে দুই বছরের মধ্যে ঝুঁকির মাত্রা কমে যায়। কিন্তু অধূমপায়ীদের
তুলনায় তখনও তা দ্বিগুণ থাকে।
৪) ডায়াবেটিস মেলিটাস
ডায়াবেটিস রোগে
রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায় এবং শরীর তা ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারে না। ফলে ডায়াবেটিসের
রোগীদের চর্বি বিপাকক্রিয়ার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে এবং এদের রক্তনালীতে অধিক হারে
আথেরোস্ক্লেরোসিস হতে দেখা যায়।
প্রধান ঝুঁকি উপাদানসমূহ ছাড়া আরও কতগুলি ঝুঁকি
উপাদান রয়েছেঃ
·
ব্যায়াম না করা
·
মেদ ভুঁড়ি
· টাইপ-এ ব্যক্তিত্বঃ অর্থাৎ যারা উচ্চাকাঙ্ক্ষী, খ্যাতি, অর্থ
এবং ক্ষমতার পেছনে নিরন্তর যারা ছুটছে, তাদেরও হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশী।
২। রক্ত সরবরাহ ঘাটতিজনিত হৃদরোগের অন্যান্য কারণ
আথেরোস্ক্লেরোসিস ইস্কিমিক হৃদরোগের প্রধান কারণ। তবে অন্যান্য
কারণেও অনেক সময় এ সমস্যা হতে পারে। যেমনঃ করোনারি ধমনীর স্পাজম (spasm) বা অনৈচ্ছিক আক্ষেপ। অ্যাওর্টিক স্টেনোসিস (aortic stenosis) কিংবা গুরুতর রক্ত স্বল্পতা (severe anaemia) থাকলেও এটা হতে পারে। আগে সিফিলিস রোগের কারণে অনেকের ইস্কিমিক হৃদরোগ হতো। আজকাল অবশ্য এর প্রকোপ নেই বললেই চলে।
রক্ত সরবরাহে ঘাটতিজনিত হৃদরোগের প্রধান উপসর্গ বুকে ব্যথা। আগেই বলা হয়েছে
এ ব্যথা সকলের নিকট অ্যানজাইনা পেকটোরিস (Angina pectoris) নামে পরিচিত। বুকের ঠিক মাঝখানে কিংবা পেটের ওপরের দিকে যন্ত্রনা শুরু হয়। সাধারণত অতিরিক্ত পরিশ্রম করলে, দ্রুত
হাঁটলে, দৌড়ালে, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলে, বেশী খাওয়া-দাওয়া করলে, দুশ্চিন্তা করলে কিংবা
দুঃসংবাদ শুনলে ব্যথা শুরু হয় এবং বুক থেকে ঘাড়,পিঠ,বাম বাহু, হাত , পেট ও চোয়ালে ব্যথা
ছড়িয়ে পড়ে। ব্যথার প্রকৃতি দম আটকে আসার মতো বা চাপা চাপা ভাব যেন মনে হয় বুকের ওপরে কেউ
ভারী পাথর চাপিয়ে দিয়েছে কিংবা মস্ত এক হাতী বুকের ওপর উঠে বসেছে। সাধারণত অ্যানজাইনার ব্যথা কয়েক মিনিট
স্থায়ী হয়। খানিকক্ষণ চুপচাপ বিশ্রাম নিলে কিংবা
অ্যানজাইনার ওষুধ দিলে ব্যথা ভালো হয়ে যায়। এই ব্যথা হলে অনেকের বুক ধড়ফড় করে, মাথা
ঘুরায় কিংবা শ্বাসকষ্ট হয়।
প্রকৃতি অনুসারে অ্যানজাইনা নানা ধরণের
হতে পারে। যেমনঃ
১। স্থিতিশীল অ্যানজাইনা (Stable angina)-এ ধরণের অ্যানজাইনার ব্যথার প্রকৃতি ও স্থায়িত্বকাল নির্ধারিত। অতিরিক্ত পরিশ্রম করলে শুরু হয়, নির্দিষ্ট
সময় স্থায়ী হয়, বিশ্রাম নিলে কিংবা ওষুধ ব্যবহার করলে কমে যায়।
২। অস্থিতিশীল অ্যানজাইনা(Unstable
angina)-এ ধরণের অ্যানজাইনার গতি-প্রকৃতি অনিশ্চিত। এটা সহসা শুরু হয়; বিশ্রামকালেও শুরু হতে
পারে, দীর্ঘ সময় স্থায়ী হয় এবং অনেক সময় এটাকে হার্ট অ্যাটাক থেকে পৃথক করা কঠিন হয়ে
পড়ে। অনেক সময় ওষুধেও
ব্যথা সহজে কমতে চায় না। এজন্য এদের হাসপাতালে নিয়ে জরুরী চিকিৎসা করা প্রয়োজন
হয়।
৩। বিবিধ অ্যানজাইনা (Variant angina)-এ ধরণের অ্যানজাইনা বিশ্রামরত অবস্থায় শুরু হতে পারে। সাধারণত করোনারি ধমনীর স্পাজম বা আক্ষেপের
ফলে এটা ঘটে। উপযুক্ত চিকিৎসা না হলে হার্ট অ্যাটাকসহ অন্যান্য জটিলতা কিংবা মৃত্যুও হতে
পারে।
কারও অ্যানজাইনা হওয়া একটি সতর্ক
সংকেত অর্থাৎ এটা সংকেত দেয় যে হৃদপিণ্ড ঠিকমতো রক্ত পাচ্ছেনা । সময়মতো চিকিৎসা
করালে সমস্যা জটিল এবং গুরুতর হওয়ার সুযোগ পায় না। কিন্তু একেবারে
নির্মূল হওয়ার সম্ভাবনা কম। এজন্য রোগীকে নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখা
উচিৎ।
অ্যানজাইনার ব্যথা যদি কখনও
ক্রমশ বাড়তে থাকে কিংবা ভীষণ তীব্র ব্যথা হয়, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশী স্থায়ী হয়,
বিশ্রাম নিলেও না কমে, এমনকি অ্যানজাইনার ওষুধ দিলেও যদি উপশম না ঘটে
তাহলে রোগীর হার্ট অ্যাটাক অর্থাৎ মায়ো কার্ডিয়াল ইনফার্কশন হয়েছে ধরে নিতে হবে। এ সময়ে রোগী প্রচন্ড
ঘামতে থাকে, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে, শ্বাসকষ্ট হয় এবং আসন্ন মৃত্যুর ভয়ে রোগী অস্থির
থাকে। এসব ক্ষেত্রে কালবিলম্ব
না করে তাকে চিকিৎসক কিংবা নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক সহসা হয়। কিন্তু এর ক্ষেত্র
তৈরি হয় অনেকদিন ধরে। অনেকে এটা আগে থেকে টের পান না; অনেকে বুঝতে পারলেও
গুরুত্ব দেন না। যে কোন জায়গাতেই হার্ট অ্যাটাক হতে পারে; কাজের
মাঝে, খেলাধূলার সময় কিংবা অফিস-আদালতে। ঘুমের মধ্যেও
এটা হতে পারে। বুড়ো বয়সে, অনেকদিন ডায়াবেটিস থাকলে কিংবা হার্টের
অপারেশনের পরে হার্ট অ্যাটাক হলে অনেকে ব্যথা
কিংবা অস্বস্তি বুঝতে পারেন না। একে নীরব হৃদরোগ বা সাইলেন্ট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন
বলে।
অনেক রোগী কিছু কিছু ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গকে অনেক
সময় হার্ট বার্নের উপসর্গ মনে করে কিংবা অসহ্য ব্যথা না হলে একে তেমন গুরুত্ব দেয় না। পেটে গ্যাস হয়েছে কিংবা বদ-হজম মনে করে নিজেরা চিকিৎসা করে। এটা খুবই বিপজ্জনক। ফলে অনেক সময়
চিকিৎসা শুরু করতে বড় বেশী দেরি হয়ে যায়। তাই হার্ট অ্যাটাক
হোক বা না হোক, সন্দেহজনক উপসর্গ দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ। কারণ হার্ট অ্যাটাকের
পরে যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা যায় ততই ভালো।
উচ্চ রক্তচাপের ফলে সৃষ্ট ইস্কিমিক হৃদরোগ কিংবা হার্ট অ্যাটাকের
ফলে অনেক সময় হৃদপিণ্ডের বিকলতা কিংবা হার্ট ফেইলিউর হতে পারে। এটা সাধারণভাবে
হার্ট ফেইল করা নামে পরিচিত।
আমরা জানি হৃদপিণ্ডের কাজই হচ্ছে রক্ত পাম্প করে শরীরের সর্বত্র
পৌঁছে দেওয়া । রক্ত সব কোষে অক্সিজেন এবং পুষ্টি যোগায়। অক্সিজেন এবং
পুষ্টি ছাড়া কোন কোষ বাঁচে না। আমরা যতদিন বাঁচি ততদিন হৃদপিণ্ডকে অবিরাম রক্ত
পাম্প করে যেতে হয়। কখনও কিছুক্ষনের জন্যও হৃদপিণ্ডের কাজে ছেদ পড়লে
মানুষের চেতনা লোপ পায়। তিন-চার মিনিটের মধ্যে হৃদপিণ্ড আবার কাজ শুরু
না করলে শরীরের অনেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যায়।
স্বাভাবিক অবস্থায় হৃদপিণ্ডের কাজের পরিমাণ প্রয়োজন অনুসারে
নিয়ন্ত্রিত হয়। আমরা যখন ঘুমাই তখন হৃদপিণ্ডকে কম রক্ত পাম্প করতে
হয়। আবার যখন ভারী কাজ করি, হাঁটি, দৌড়াই কিংবা সিঁড়ি
বেয়ে ওপরে উঠি তখন হৃদপিণ্ডকে অতিরিক্ত রক্ত পাম্প করতে হয়। আমরা যত বেশী
শারীরিক পরিশ্রম করি, হৃদপিণ্ডকে তত বেশী রক্ত পাম্প করতে হয়। একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত হৃদপিণ্ড এভাবে কাজ
করতে পারে। কিন্তু অনেক সময় হৃদপিণ্ড বিভিন্ন অংশে প্রয়োজন
মতো রক্ত সরবরাহ করতে পারে না। এর ফলে হৃদপিণ্ড এবং শিরার মধ্যে রক্ত জমতে শুরু
করে। হৃদপিণ্ডের এ রকম বিকলতা বা অপারগতাকে হার্ট ফেইলিউর
( heart failure) বলে।
হৃদপিণ্ডের ডান অংশ কিংবা বাম অংশ পৃথকভাবে বিকল হতে পারে
কিংবা দুটো অংশ একই সঙ্গে বিকল হতে পারে। হৃদপিণ্ডের বাম অংশ বিকল হলে ফুসফুসের রক্ত জালিকায় রক্ত
জমে যায়; এর ফলে মারাত্মক শ্বাস কষ্ট এবং কাশি হয়। রোগী চিত হয়ে
বিছানায় স্বচ্ছন্দে শুতে পারে না। আর হৃদপিণ্ডের ডান অংশ বিকল হলে ঘাড়ের শিরায় রক্ত
জমে ফুলে ওঠে, যকৃতে রক্ত জমে বড় হয়ে যায় এবং পা ও শরীর ফোলে। এ ধরণের হার্ট
ফেইলিউর কনজেসটিভ হার্ট ফেইলিউর (congestive heart failure) নামে পরিচিত।
উচ্চ রক্তচাপ এবং এর ফলে সৃষ্ট ইস্কিমিক হৃদরোগ বিশেষ করে
হার্ট অ্যাটাকের পড়ে হার্ট ফেইলিউর হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের
কারণে প্রথমে হার্টের বাম অংশ বিকল হয়; তবে পরবর্তী পর্যায়ে দুই অংশই বিকল হয়ে যেতে
পারে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে হৃদবিকলতার প্রধান লক্ষণ শ্বাস কষ্ট। প্রথম দিকে অতিরিক্ত
পরিশ্রম করলে শ্বাসকষ্ট হয়। একে পরিশ্রমজনিত শ্বাসকষ্ট (exertional breathlessness) বলে।
অনেকের সহসা মাঝরাতে শ্বাসকষ্ট হতে দেখা যায়। সাধারণত ঘুমোতে
যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে তারা শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন। বিছানায় উঠে শ্বাস
নেয় কিংবা জানালা-দরজা খুলে মুক্ত বায়ুর জন্য ছটফট করে। এর সঙ্গে কাশিও
থাকে। রাতে সহসা এ রকম শ্বাসকষ্ট হওয়াকে হঠাৎ হঠাৎ নৈশকালীন
শ্বাসকষ্ট (paroxysmal
nocturnal dyspnoea) বলে।
হার্ট ফেইলিউরের ধরণ মারাত্মক হলে রোগী প্রতিনিয়ত শ্বাসকষ্ট
অনুভব করে এবং কখনই চিত হয়ে স্বাভাবিকভাবে শুতে পারে না। শ্বাসকষ্ট ও কাশি
ছাড়া এদের শারীরিক দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি অন্যান্য উপসর্গ থাকতে পারে।
রক্ত সরবরাহে ঘাটতিজনিত হৃদরোগের ফলে অনেক রোগী হঠাৎ মৃত্যুবরণ
করতে পারে। সাধারণত হৃদপিণ্ডের বৈদ্যুতিক উদ্দীপনার ছন্দহীনতা
(cardiac arrhythmias) কিংবা হৃদপিণ্ডের সংকোচন-প্রসারণ বন্ধ
(Ventricular asystole) হয়ে যাওয়ার ফলে এমন ঘটে।
বাম নিলয়ের অতিবৃদ্ধি এবং হৃদপিণ্ডের বিকলতা
দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচাপ থাকলে হৃদপিণ্ডের বাম নিলয়কে বেশী
কাজ করতে হয়। এর ফলে বাম নিলয় পুরু হয়ে যায় যা বাম নিলয়ের অতিবৃদ্ধি
( Ventricular hypertrophy) নামে পরিচিত। বাম নিলয় মোটা এবং পুরু হয়ে গেলে পুষ্টির জন্য অতিরিক্ত রক্ত সরবরাহের দরকার
হয়। কিন্তু আসলে রক্ত
সরবরাহ তেমন বাড়ানো সম্ভব হয় না; বরং করোনারি ধমনীতে আথেরোস্লেরোসিস হওয়ার ফলে প্রয়োজনের
তুলনায় রক্ত সরবরাহ আরও কমে যায়। এর ফলে এসব ক্ষেত্রে রক্ত সরবরাহ ঘাটতিজনিত বা ইস্কিমিক হৃদরোগ
হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত হৃদ বিকলতা বা হার্ট ফেইলিউর ঘটতে পারে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে উচ্চ রক্তচাপের ফলে হৃদপিণ্ড ক্ষতিগ্রস্থ
হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশী। রক্ত সরবরাহ ঘাটতিজনিত
বা ইস্কিমিক হৃদরোগ বিশেষত হার্ট অ্যাটাকের পেছনেও এর বিরাট ভূমিকা রয়েছে। হৃদরোগসহ এর আনুষঙ্গিক নানা রকম গুরুতর
জটিলতা এড়ানোর জন্য উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাবধানতার সঙ্গে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখলে
রোগীদের লক্ষণ এবং উপসর্গের তীব্রতা কমে আসে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের
জন্য ওষুধ নির্বাচনে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবনে হিতে
বিপরীত হতে পারে।
রক্তে অস্বাভাবিক কোলেস্টেরল
আজকাল কোলেস্টেরল সম্পর্কে সকলেই সচেতন। কারও কারও কোলেস্টেরল
সচেতনতা আবার অনেক বেশী- রীতিমতো আতঙ্কজনক পর্যায়ে পড়ে। এ সম্পর্কে সঠিক
ধারনার অভাবই এর কারণ।
কোলেস্টেরল স্টেরয়েডজাতীয় লিপিড। মানুষের স্বাভাবিক
কাজকর্মের জন্য এটি একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। স্টেরয়েড হরমোন
এবং পিত্ত-লবণ তৈরির জন্য কোলেস্টেরল দরকার হয়। কোষের আবরণী পর্দারও
একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এই কোলেস্টেরল। সুতরাং কোলেস্টেরল ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। কিন্তু রক্তে
অতিমাত্রায় কোলেস্টেরল আবার আমাদের জন্য অনেক সময় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য রক্তে কোলেস্টেরলের
একটি স্বাভাবিক মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী।
আমাদের শরীরে কোলেস্টেরলের উৎস দুইটি।
প্রথমত খাবার থেকে আমরা যথেষ্ট কোলেস্টেরল পাই। ডিমের কুসুম,
গরু-খাসির মগজ, গরু-খাসির মাংস, কলিজা, কিডনি, চিংড়ি, কাঁকড়া, মাখন, পনির, দুধ, আইসক্রিম
প্রভৃতি খাবারে প্রচুর কোলেস্টেরল থাকে। এদের মধ্যে ডিমের
কুসুম এবং গরু-খাসির মগজে সবচেয়ে বেশী কোলেস্টেরল থাকে।
দ্বিতীয়ত খাবার-দাবার ছাড়া শরীরের ভেতরেও কোলেস্টেরল তৈরি
করার নিজস্ব ব্যবস্থা আছে।
স্বাভাবিক অবস্থায় খাদ্যের কোলেস্টেরল এবং শরীরের নিজস্ব
তৈরি কোলেস্টেরলের পরিমানের মধ্যে একটি ভারসাম্য থাকে। এর ফলে কখনও কখনও
বেশী কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার খেলেও রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ অতিরিক্ত বেড়ে যায় না। কারণ শরীর তখন
নিজের কোলেস্টেরল তৈরি করা কমিয়ে সার্বিক পরিমাণ
নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এই ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়াটি খুব
জটিল। আজকাল দেখা যাচ্ছে রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের
মূল ভূমিকা পালন করে খাবারের চর্বি বা ফ্যাট। এখন চর্বি বা
ফ্যাট বলতে শুধু কোলেস্টেরল বোঝায় না। এটা মূলত গ্লিসারল এবং ফ্যাটি অ্যাসিডের যৌগ। দুই রকমের ফ্যাট
বা চর্বি রয়েছেঃ সম্পৃক্ত চর্বি (saturated fat ) এবং অসম্পৃক্ত চর্বি (unsaturated fat)। সম্পৃক্ত ফ্যাটি আসিড
বেশী থাকলে সেটাকে সম্পৃক্ত চর্বি বলা হয়। প্রাণীজ চর্বি যেমনঃ গরু, খাসী, ভেড়া, শুকর ইত্যাদির
মাংসে প্রচুর সম্পৃক্ত চর্বি থাকে। কিন্তু উদ্ভিজ্জ চর্বি এবং সামুদ্রিক মাছের তেলে বেশী অসম্পৃক্ত চর্বি থাকে।
কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য ফ্যাট রক্তে গলে না। এজন্য এরা রক্তে
মুক্ত অবস্থায় চলাচল করতে পারে না। রক্তে কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য ফ্যাট বিশেষ বাহক-প্রোটিনের
সঙ্গে যুক্ত হয়ে চলাচল করে। এ সকল বিশেষ বাহক-প্রোটিন এবং ফ্যাটের সমষ্টি কণা
লাইপোপ্রোটিন নামে পরিচিত। রক্তে কোলেস্টেরল পরিবহণের জন্য লাইপোপ্রোটিন প্রয়োজনীয়। যে সকল লাইপোপ্রোটিনে
প্রোটিনের পরিমাণ কম কিন্তু ফ্যাটের পরিমাণ বেশী সেগুলির ঘনত্ব কম হয়। এদের কম ঘনত্বের
লাইপোপ্রোটিন (low
density lipoprotein) বা এলডিএল বলা
হয়। এলডিএল-এর মধ্যে ৭০ ভাগই কোলেস্টেরল। শরীরে কোলেস্টেরলের প্রধান বাহক এলডিএল। এটা লিভার থেকে কোলেস্টেরল বয়ে এনে
বিভিন্ন ধমনীতে জমা করে।
অন্যদিকে যে লাইপোপ্রোটিনে ফ্যাটের পরিমাণ কম আর প্রোটিনের
পরিমাণ বেশী তাদের উচ্চ ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন (high density lipoprotein) বা এইচডিএল বলা হয়। এরা শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে কোলেস্টেরল বের করে
নিয়ে লিভারে ফেরত আনে। সে জন্য এইচডিএল-কে ভালো কোলেস্টেরল আর এলডিএল-কে
মন্দ কোলেস্টেরল বলা হয়। রক্তে এলডিএল-এর পরিমাণ বেড়ে যাওয়া মানেই কোলেস্টেরল
বেড়ে যাওয়া এবং তা ক্ষতিকর। অন্যদিকে এইচডিএল বেশী হওয়া ভালো। অবশ্য এটি একটি
আপেক্ষিক বিষয়। এজন্য রক্তে মোট কোলেস্টেরল এবং এইচডিএল-এর অনুপাত
নির্ণয় করা উত্তম।
রক্তে কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা কত হওয়া উচিৎ-এসব নিয়ে
যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য বিভাগ একজন পূর্ণ বয়স্ক
মানুষের রক্তে কোলেস্টেরলের সীমা বেঁধে দিয়েছে ২০০ মিঃ গ্রাঃ/ ডেসিঃ লিঃ । বিগত অর্ধ শতাব্দীতে
৫০ বছরে মার্কিনীদের গড় কোলেস্টেরল মাত্রা ১৫ মিঃ গ্রাঃ/ ডেসিঃ লিঃ বা ৭% কমেছে। কিন্তু তারপরও
শতকরা ৫০ জনের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা ২০০ মিঃ গ্রাঃ/ ডেসি লিটারের বেশী। ২০% লোকের ২৪০
মিঃ গ্রাঃ/ ডেসি লিটারের ওপরে এবং ৩০% মানুষের অবশ্যই কোলেস্টেরল কমানোর চিকিৎসা নেওয়া
উচিৎ।
আমাদের দেশের জনগনের কোলেস্টেরল সম্পর্কে এত বিস্তারিত তথ্য
নেই। তবে হৃদরোগের হার যেভাবে বাড়ছে, তাতে কোলেস্টেরল
সম্পর্কে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার।
১৯৯৯ সালে এক হিসেবে দেখানো হয়েছে যাদের রক্তে কোলেস্টেরল
১৯০ মিঃ গ্রাঃ / ডেসি লিঃ , তাদের কোলেস্টেরল আরও ১০% কমালে হৃদরোগ ২০% কমে যায়। কিন্তু কোলেস্টেরলের
মাত্রা শুধু কমলেই হবে না, সেখানে এইচডিএল-এর মাত্রা আবার যথেষ্ট থাকতে হবে। এ সম্পর্কে আমেরিকার জাতীয় কোলেস্টেরল
শিক্ষা কার্যক্রম (National Cholesterol Education Program) ১৯৯৩ সালে একটি নীতিমালা ঠিক করে দিয়েছে। এই নীতিমালার আসল কথা হচ্ছেঃ হৃদরোগের
ঝুঁকি কমানোর জন্য এলডিএল এবং মোট কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমাতে হবে। আর এইচ ডি এল-এর পরিমাণ বাড়াতে হবে।
সারণী-৮ পূর্ণবয়স্ক
মানুষের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় কোলেস্টেরল শিক্ষা
কার্যক্রমের নীতি নির্দেশনা
|
|||
পর্যায়
|
মোট কোলেস্টেরল
( মিঃ গ্রাঃ/ ডেসিঃ
লিঃ)
|
এলডিএল কোলেস্টেরল
( মিঃ গ্রাঃ/ ডেসিঃ
লিঃ)
|
এইচডিএল কোলেস্টেরল
( মিঃ গ্রাঃ/ ডেসিঃ
লিঃ)
|
আদর্শ
|
<১০০
|
>৬০
|
|
কাম্য
|
<২০০
|
<১৩০
|
|
সীমান্তিক(Borderline)
|
২০০-২৩৯
|
১৩০-১৫৯
|
|
অস্বাভাবিক
|
>২৪০
|
>১৬০
|
<৩৫
|
m~Î : Journal of American
Medical Association 269 ; 3015, 1993
এজন্য সবার রক্তে মোট কোলেস্টেরল এল ডি এল এবং এইচ ডি এল-এর
পরিমাণ জানা দরকার। এটা জানলে ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণের জন্য একটি
অনুপাত বের করা যায়। নিয়মটা খুবই সহজঃ
ঝুঁকির অনুপাত=
মোট কোলেস্টেরল/ এইচ ডি এল কোলেস্টেরল
এই অনুপাত সাধারণত
৪.৫ হওয়া উচিৎ।
সারনি-৯ কোলেস্টেরল ঝুঁকির অনুপাত (Cholesterol risk ratio)
|
|
অনুপাত
|
ঝুঁকি
|
৬.০
|
বেশী
|
৫.০
|
স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী
|
৪.৫
|
গড়পড়তা
|
৪.০
|
স্বাভাবিকের চেয়ে কম
|
৩.০
|
কম
|
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ
করা দরকার যে, কোলেস্টেরলের মাত্রা খুব কম হওয়াও খারাপ। ডঃ ড্যানিয়েল
জ্যাকবস (Dr. Daniel Jacobs) তার সহযোগীদের নিয়ে ৬৮,০০০ মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে ১৯৯২ সালে যে ফলাফল দিয়েছেন
তাতে দেখা যায় কোলেস্টেরল বেশী হলে মানুষ মারা যায় সত্য ; কিন্তু কোলেস্টেরল কম হলেও মৃত্যুহার
বেড়ে যায়। তারা দেখতে পেয়েছেন যাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা ১৪০ থেকে ১৬০ মিঃ গ্রাঃ / ডেসি
লিটার,তাদের মৃত্যুর হার বেশী। অবশ্য এদের মৃত্যুর প্রধান কারণ- ক্যানসার, মস্তিস্কের
রক্তক্ষরণ, আন্ত্রিক রোগ ইত্যাদি। পরবর্তীকালে অনেকে গবেষণায় অবশ্য ড্যানিয়েল জ্যাকবস-এর
সমালোচনা করেছেন।তারা কম কোলেস্টেরল ক্ষতিকর নয়-এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে
সুস্থ থাকার জন্য আমরা কি করবো? এর উত্তর আমাদের রক্তে এল ডি এল কোলেস্টেরল কমাতে হবে
এবং এইচ ডি এল কোলেস্টেরল বাড়াতে হবে।
এইচ ডি এল বাড়ানোর
সহজ উপায়ঃ
·
শরীরের ওজন কমানো
·
নিয়মিত ব্যায়াম করা
·
ধূমপান পরিহার করা।
আর এল ডি এল কমানো?
প্রধান শর্ত রসনা সংযত করা। এ জন্যঃ
·
প্রাণীজ চর্বিজাতীয় খাবারের পরিমাণ কমাতে হবে
·
ননি,মাখন,ঘি ইত্যাদি কম খেতে হবে
·
ডিমের কুসুম ও মগজ পরিহার করতে হবে।
শস্যবীজ থেকে
পাওয়া তেল এবং সামুদ্রিক মাছ ও মাছের তেলে প্রচুর অসম্পৃক্ত ফ্যাট থাকে। এ সব খাবার খেলে
এল ডি এল-এর পরিমাণ কমে এবং এইচ ডি এল-এর পরিমাণ বাড়ে। শাক সবজী , ফল
মূল ইত্যাদি যে সব খাবারে আঁশ বেশী সে সব খাবার বেশী খেলে এল ডি এল কোলেস্টেরল কমে। উদ্ভিজ্জজাত কোন
খাদ্যেই কোলেস্টেরল থাকে না; এতে ফ্যাটের পরিমাণ সামান্য। তবে ব্যতিক্রম
হচ্ছে নারকেল তেল এবং পাম ওয়েল। এ দুইটি তেলেই প্রচুর সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড
থাকে এবং এর ফলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে।
No comments:
Post a Comment