।।তেরো।। মেয়েদের উচ্চ রক্তচাপ



 
          উচ্চ রক্তচাপের ওপর এ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নারীপুরুষ নির্বিশেষে পরিচালিত হয়েছে কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার ফলাফলের ক্ষেত্রে নারীপুরুষের মধ্যে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোন পার্থক্য  দেখা যায়নি অবশ্য একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, সন্তান ধারণক্ষম বয়সে মহিলাদের হৃদরোগের হার পুরুষদের তুলনায় কম থাকে এজন্য এসব পর্যবেক্ষণের ফলাফল বিশ্লেষণ করা জটিল তবে রজোনিবৃত্তির পর মহিলাদের উচ্চ রক্তচাপের প্রকৃতি এবং চিকিৎসা পুরুষদের থেকে বিশেষ কোন ভিন্নতা দেখা যায় না কিন্তু মহিলাদের উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় ও চিকিৎসার বেলায় তিনটি বিশেষ প্রেক্ষাপট মনে রাখতে হবেঃ  
·        উচ্চ রক্তচাপ ও জন্ম নিরোধক বড়ি
·        গর্ভবতী মহিলাদের উচ্চ রক্তচাপ
·        রজোনিবৃত্তির পর উচ্চ রক্তচাপ
উচ্চ রক্তচাপ ও জন্ম নিরোধক বড়ি
যে সকল মহিলা জন্ম নিরোধক বড়ি ব্যবহার করেন তাদের রক্তচাপ সামান্য বাড়তে পারে  তবে সাধারণত এটি স্বাভাবিক মাত্রার মধ্যেই সীমিত থাকে যারা পাঁচ বছর কিংবা তার চেয়ে বেশী সময় ধরে নিয়মিত জন্ম নিরোধক বড়ি সেবন করে আসছেন তাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার প্রবণতা সাধারণত বেড়ে যায় বয়স বেশী হলে , ওজন বাড়লে কিংবা দীর্ঘদিন বড়ি সেবন করলে ঝুঁকি বাড়ে যে সব মহিলার বয়স পঁয়ত্রিশের ওপরে এবং যারা ধূমপান করেন তাদের অবশ্যই ধূমপান পরিহার কর উচিৎ সাধারণত জন্ম-নিরোধক বড়ি যারা এবং ধূমপান দুটোই  একসঙ্গে চালিয়ে যান তাদের হৃদরোগ বেশী হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে অবশ্য এ সকল পর্যবেক্ষণ যখন করা হয়েছিল তখন জন্ম-নিরোধক বড়িতে উঁচু মাত্রায় ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন ব্যবহার করা হতো আজকাল জন্ম-নিরোধক বড়িতে খুবই স্বল্প মাত্রায়  ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন ব্যবহার করা হয় সুতরাং এ সকল বড়ি ব্যবহার করলে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি আগের চেয়ে অনেক কম হওয়াই স্বাভাবিক তবে এ সম্পর্কে আরও ব্যাপক গবেষণা হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে


জন্মনিরোধক বড়ি কিভাবে উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে তা এখনও পরিস্কার নয় তবে এটা ব্যবহারের ফলে কারও রক্তচাপ বেড়ে গেলে এটা বন্ধ রাখাই ভালো এটা বন্ধ করার কয়েক মাসের মধ্যেই সাধারণত রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়ে আসে তবে অন্যান্য জটিলতা থাকলে কিংবা গর্ভধারণ বিপজ্জনক হলে এ সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ এদের জীবনাচরণ পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে এবং রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে  

গর্ভবতী মহিলাদের উচ্চ রক্তচাপ
গর্ভবতী মহিলাদের উচ্চ রক্তচাপ শিশুমৃত্যু এবং মায়ের মৃত্যুর বড় কারণ গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন কারণে উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হতে পারে এগুলিকে সাধারণত চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়ঃ  
1.    ক্রনিক উচ্চ রক্তচাপঃ অর্থাৎ গর্ভধারণের আগে থেকেই যদি কোন মহিলার উচ্চ রক্তচাপ থেকে থাকে
2. প্রি ইক্লাম্পসিয়া এবং ইক্লাম্পসিয়াঃ এরকম অবস্থা শুধু গর্ভবতী মহিলাদেরই হয়
প্রি-ইক্লাম্পসিয়া হলে গর্ভবতী মায়ের হাত-পা ফুলে যায় , প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হয় এবং উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হয় এরসঙ্গে  খিঁচুনি হলে তাকে ইক্লাম্পসিয়া বলা হয়
3.   ক্রনিক উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে প্রি-ইক্লাম্পসিয়াঃ অর্থাৎ কারও আগেই উচ্চ রক্তচাপ ছিল এবং গর্ভধারণের পর তার প্রি-ইক্লাম্পসিয়ার লক্ষন-উপসর্গ শুরু হয়েছে           
4.    সাময়িক উচ্চ রক্তচাপঃ  গর্ভধারণের পর কোন মহিলার রক্তচাপ বাড়লেও তার প্রি-ইক্লাম্পসিয়ার লক্ষণ উপসর্গ দেখা দেয়নি এবং সন্তান জন্ম দানের পরে এদের রক্তচাপ আবার  স্বাভাবিক হয়ে যায় গর্ভধারণের আগের রক্তচাপ সঠিক জানা না থাকলে গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় করার ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হয় এজন্য সন্তান ধারণক্ষম  সকল মহিলার স্বাভাবিক রক্তচাপ কত তা জানা থাকা উচিৎ এবং গর্ভধারণের পরে একজন উপযুক্ত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা উচিৎ
প্রি-ইক্লাম্পসিয়া ও ইক্লাম্পসিয়া
          ইক্লাম্পসিয়া একটি গুরুতর রোগ আমাদের দেশে গর্ভবতী মায়েদের মৃত্যুর এটি অন্যতম একটি প্রধান কারণ বিভিন্ন হিসেব অনুসারে দেখা যায়, বাংলাদেশে গর্ভবতী অবস্থায় প্রতি হাজারে ১০ থেকে ১৫ জন ইক্লাম্পসিয়ায় ভুগে থাকে উন্নত দেশগুলোতে আজকাল এটা বিরল কারণ উপযুক্ত অ্যান্টি-ন্যাটাল চেক আপের সাহায্যে এটা সহজেই প্রতিরোধ করা যায়  
সাধারণত গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহের পর হাত-পা ফুলে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ এবং প্রস্রাবের সঙ্গে প্রোটিন নিঃসৃত হওয়াকে প্রি-ইক্লাম্পসিয়া বলে এটাকে ইক্লাম্পসিয়ার পূর্ববর্তী অবস্থা বলা যেতে পারে প্রি-ইক্লাম্পসিয়ার কোন পর্যায়ে খিঁচুনি হলে তাকে ইক্লাম্পসিয়া বলা হয় সাধারণত প্রথম সন্তান ধারণকালে মেয়েদের এ রোগ বেশী হয় একবার ইক্লাম্পসিয়ার খিঁচুনি শুরু হলে অনেক সময় জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসা করেও রোগীকে বাঁচান যায় না ইক্লাম্পসিয়ায় মা ও শিশু উভয়েরই মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে এজন্য এ ক্ষেত্রে শিশুর চেয়ে মায়ের জীবন রক্ষার চেষ্টা করা হয়
        এই জন্য প্রত্যেক গর্ভবতী মায়ের নিয়মিত অ্যান্টি ন্যাটাল চেক আপ করানোই এই ভয়ঙ্কর রোগটি প্রতিরোধ করার সহজ উপায়

রজঃনিবৃত্তির পর উচ্চ রক্তচাপ

          রজঃনিবৃত্তির(menopause) পর একজন মহিলা এবং একই বয়সের একজন পুরুষের উচ্চ রক্তচাপের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই এদের চিকিৎসা পদ্ধতিও মোটামুটি একই রকম কিন্তু আজকাল রজঃনিবৃত্তির পর অনেকে হরমোন প্রতিস্থাপন  (hormone replacement therapy – HRT) চিকিৎসা গ্রহণ করেন এর ফলে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে এজন্য এ সম্পর্কে সচেতনতা ও সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে  
          আগে রজঃনিবৃত্তি সম্পর্কে যত না বিজ্ঞান সম্মত চিন্তা ভাবনা হতো, তার চেয়ে বেশী ছিল ভুল ধারণা এবং কুসংস্কার কিন্তু সমস্যা তেমন প্রকট ছিল না কারণ রজঃনিবৃত্তির বয়স পেরনো মহিলার সংখ্যা তেমন বেশী ছিল না এখন মহিলাদের গড় আয়ু অনেক বেড়েছে  কোটি কোটি মহিলা রজঃনিবৃত্তির পরেও মোট আয়ুর অন্তত তিন ভাগের এক ভাগ সময় বেঁচে আছেন তাই এ সম্পর্কে তাদের মনে অনেক প্রশ্ন  
          সমস্যা অবশ্য রজঃনিবৃত্তির টুক টাক অস্বস্তি দূর করার মধ্যে সীমিত নয় বিভিন্ন হিসেবে দেখা যায়, শতকরা মাত্র ৫ থেকে ১৫ জন মহিলা রজঃনিবৃত্তির জটিলতা নিরসনের জন্য চিকিৎসকের নিকটে আসেন সে জন্য এখন সকলের নজর রজঃনিবৃত্তির পরের গুরুতর সমস্যাগুলির দিকে এ সবের মধ্যে হৃদরোগ, ক্যানসার এবং হাড়ের সমস্যা উল্লেখযোগ্য আর শেষ বয়সে যৌনতৃপ্তি লাভের আকাঙ্ক্ষাও অনেকের থাকেএ পর্যন্ত যে সকল গবেষণা হয়েছে তাতে রজঃনিবৃত্তির জন্য হরমোন প্রতিস্থাপন উপকারী, এমন কি অনেক ক্ষেত্রে জীবন রক্ষাকারী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে

শুধু হৃদরোগের কথা বিবেচনা করলে দেখা যায়, রজঃনিবৃত্তির পর হরমোন চিকিৎসার ফলে মেয়েদের মৃত্যুহার অর্ধেক কমে যায় প্রাকৃতিকভাবে মেয়েদের শরীরে যে ইস্ট্রোজেন তৈরি হয় তা হৃদরোগ থেকে তাদের রক্ষা করে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের পর থেকে ইস্ট্রোজেন তৈরির পরিমাণ ধীরে ধীরে কমতে থাকে রজঃনিবৃত্তির মাধ্যমে তার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে শরীরে অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গে  ইস্ট্রোজেন হরমোনের গ্রাহক অণু (oestrogen receptor) রয়েছে অর্থাৎ  সকল স্থানে ইস্ট্রোজেনের কিছু না কিছু কাজ রয়েছে ফলে ইস্ট্রোজেন তৈরি বন্ধ হয়ে গেলে যৌনাঙ্গসমূহ, মূত্রযন্ত্র, স্তন, ত্বক, চুল, হাড়, নিতম্ব, মস্তিস্ক, রক্তনালী এবং হৃদযন্ত্রসহ পুরো শরীরেই তার অভাবের ছাপ পড়ে হৃদরোগের  হার বিশেষভাবে বেড়ে যায় কারণ ইস্ট্রোজেন কমে যাওয়ার ফলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায় রজঃনিবৃত্তির ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে মেয়েদের হার্ট অ্যাটাকের হার প্রায় ৩০ গুণ বেড়ে যায় ইস্ট্রোজেন  প্রতিস্থাপনের ফলে তা অন্তত ৫০ শতাংশ কমে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও হরমোন প্রতিস্থাপনে কোন মানা নেই কারণ এর ফলে বরং রক্তচাপ এবং হৃদরোগের ওপর উপকারী প্রভাবই পড়ে তবে হরমোন চিকিৎসা শুরু করার পড়ে যাদের রক্তচাপ বেড়ে যায়, তাদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে  
          সুতরাং যথাযত পরীক্ষা- নিরীক্ষা এবং উপযুক্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রজঃনিবৃত্তির পর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও হরমোন দিয়ে চিকিৎসা করা উচিৎ

No comments:

Post a Comment